যাপন এবং জীবন

আমার ডর্মের ছয় স্টেশন পরে "হফগার্ডেন" বলে একটা পার্ক আছে। আদতে তেমন দেখার মত কিছুই না, সাজানো গোছানো পরিপাটি অবস্থা। বেশ কিছু ফোয়ারা আছে আর আছে একটা গম্বুজ দিয়ে ঘেরা জায়গা। সেই গম্বুজের নিচে বেশি খানিকটা ফাঁকা জায়গা। আমার মতে এই গম্বুজের নিচের জায়গাটা মিউনিখের অন্যতম সুখী একটা জায়গা। এই গম্বুজের নিচে সবসময়, বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে বিভিন্ন নাচ হয়। কখনো আফ্রো-কিউবান রুম্বা, কখনো ব্রাজিলিয়ান সাম্বা কখনো ওয়ালটজ। বুড়ো-বুড়ি থেকে শুরু করে টিনএজরাও সমান তালে অংশগ্রহণ করে। সামারে সাধারণত খুবই ফেস্টিভ একটা জায়গা।
আমার এসব জায়গায় যাওয়া হয় কম ইদানীং, লকডাউনে থাকতে থাকতে মনটাও লকডাউনে চলে গেছে। বের হওয়ার ইচ্ছা এবং শক্তি কোনটাই তেমন থাকে না। তবুও কি ভেবে যেন গেলাম সেদিন সকালে।
গম্বুজের নিচে তাকিয়ে দেখি দুইজন মাত্র মানুষ নাচ প্র্যাক্টিস করছে, সম্ভবত কিউবান চা-চা ড্যান্স বা সেই গোত্রীয় কিছু। যেই মধ্যবয়সী ভদ্রলোক শিখছেন তিনি মনে হলো ইউরোপীয়ান আর যেই ভদ্রমহিলা শেখাচ্ছেন তিনি এশিয়ান। আমি টানা ৪৫ মিনিট ধরে তাদের নাচের কান্ডকীর্তন দেখে গেলাম। জীবনে এত প্যাশন নিয়ে ভুল নাচতে কাওকে আমি দেখিনি! লোকটার চোখে মুখে এমনকি বডি ল্যাঙ্গুয়েজেও প্রচন্ড আগ্রহ নাচ শেখার, কিন্তু নাচের ৮০% স্টেপই তার এলোমেলো, এমনকি যাকে দেখে নেচে যাচ্ছেন তার নাচের সাথে সাদৃশ্যের যোজন যোজন তফাত। কিন্তু তিনি নেচেই যাচ্ছেন, বিরামহীন ভাবে। যিনি নাচ শেখাচ্ছেন, তার চাহনিভরা শুধু শেখানোর আগ্রহ, কিন্তু তার ছাত্র কিছুই তুলতে পারছে না। কিন্তু তাতে ভদ্রমহিলার তেমন কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি অধীর আগ্রহ নিয়ে প্রতিটা স্টেপ দেখিয়েই যাচ্ছেন এবং দেখিয়েই যাচ্ছেন। একজন ভুল করেই যাচ্ছে তাতেও তার আনন্দের শেষ নেই, আরেকজন এতসময় ধরে নাচ দেখাচ্ছেন তবুও ভুল নেচে যাচ্ছে তার স্টুডেন্ট কিন্তু তাতে তার শেখানোর আগ্রহে কোন ভাঁটা পড়ছে না।
এমনটাই কি হওয়ার কথা না জীবনে? যে জীবন নিজের সে জীবন যাপনের হিসেবও নিজস্ব হওয়া উচিত না? ভুল করলাম অথবা ঠিক তাতে জীবনের প্রতি আগ্রহের কমতি হওয়া কি উচিত? সফল হলাম অথবা বিফল তাতে আনন্দের দাড়িপাল্লায় কমবেশি হওয়া কি ঠিক? মাঝের এই নাচটুকুই কি জীবনের সবকিছু না?

Comments

Popular posts from this blog

হসন্ত-২

অচেনা সিম্ফোনি

তোমরা বরং “বংশোদ্ভূত”ই থাকো!