সমসাময়িক ধর্ষণের গল্প

বারবার ঘড়ি দেখলে কি সময় ধীরে ধীরে যায়? এখন আপাতত রূপার তাই মনে হচ্ছে। গত ৪৫ মিনিটে কমপক্ষে কুড়িবার ফোন চেক করে ফেলেছে সে। আবিরের আসার নাম গন্ধ নেই। সময় নিয়ে রূপা যতটা সিরিয়াস, আবির ঠিক ততটাই বেখেয়াল। ওর হাতঘড়ি থেকে শুরু করে দেয়ালঘড়ি সব আধা ঘণ্টা আগানো, তাও সময়মত সে কোথাও পৌঁছাতে পারে না। মাথার উপরের সূর্যটা মনে হচ্ছে রূপার মেজাজের সাথে পাল্লা দিয়ে তাতিয়ে উঠছে। একবার ভাবলো রেগে মেগে চলেই যাবে, কিন্তু এতো সাধের গিফটতো দেয়া হবে না। সপ্তাহখানেক আগে আবিরের ফোনটা ছিনতাই হয়েছে। এখন আবার নতুন ফোন কেনার মত টাকা নেই জানে রূপা। তাই নিজেই নিজের জমানো টাকা থেকে একটা ফোন কিনেছে, খুব দামি কিছু না তবে কাজ চালানোর মত। আসার পরেই এমন একটা হাসি দেবে যে রূপার পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠবে এবং একই সাথে সদ্য জন্ম নেয়া হাসিটাও আটকাতে পারবে না। নিজেই মাঝে মাঝে বোঝে না রূপা, এই ছেলের উপর রাগ কেন সে করতে পারে না। 
আশেপাশে ভীষণ তোড়জোড় চলছে কোরবানীর। এই ঈদের আয়োজনটা কেমন মন ভারী করা, আনন্দের সাথে সবাই বিসর্জনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মানুষমাত্রই বোধহয় এমন পারে। রূপার এসব ভালো লাগে না। মন অন্যদিকে ফেরাতে ফেসবুক ঘাটে সে। এমনসময় পেছন থেকে লাটসাহেব এসে পেছন থেকে পিঠে টোকা দিলেন। রাগতে গিয়েও হেসে দিলো রূপা, প্রতিবারের মত। 
রূপাঃ তুমি জানো আমি কতক্ষণ ধরে তোমার জন্য ওয়েট করছি? 
আবিরঃ এই টাইটেলে একটা কবিতা থাকা উচিত কি বলো? প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য খুবই কমন একটা লাইন। কিন্তু পেছনের গল্পগুলো ভিন্ন। বেশ একটা কবিতা হবে তাই না? 
রূপাঃ বাহ! (ব্যঙ্গ করে) আমার অভিযোগ তোমার কাছে কবিতার উৎস হয়ে দাড়াচ্ছে দেখছি? 
আবিরঃ একদম! সাধে কি আমি তোমাকে আমার জীবনের প্রেরণা বলি? 
রূপাঃ (আবিরের কান টেনে) জানো না অপেক্ষা করতে পারি না, প্রতিদিন এভাবে দেরি করো কেন হ্যাঁ? 
আবিরঃ (কোনমতে কান ছাড়িয়ে) ছাড়ো, ছাড়ো। কবিদের কান ধরতে নেই। কবিরা হচ্ছে ঈশ্বরের প্রতিনিধি, তাদের অসম্মান করতে নেই (মুচকি হেসে)। আমাদের সাথে কথা বলতে হবে...... 
রূপাঃ  (চেঁচিয়ে ওঠে) আবির! 
আবির জড়িয়ে ধরে রূপাকে। নিজেই নিজের কান ধরে মাফ চায়। 
রূপাঃ (মোবাইলের ব্যাগটা বাড়িয়ে দিয়ে) ধরো 
আবিরঃ কি? (খোলে ব্যাগ) রূপা কেন? আমি নিজেই কিনতাম! 
রূপাঃ তো? আমি দিলে সমস্যা কি? 
আবিরঃ এতগুলো টাকা। তুমি এত টাকা নষ্ট করো! কোন দরকারই ছিল না। 
রূপাঃ গত দুই সপ্তাহ ধরে রাতে তোমার কবিতা শুনি না, খেয়াল আছে? 
আবিরঃ বলতা একবার! কয়েকটা আবৃত্তির সিডি কিনে দিতাম। তাও অনেক কম টাকা খরচ হতো। (হেসে ওঠে উচ্চস্বরে) 
রুপাঃ (রূপা গলা চেপে ধরে আবিরের। আবির জড়িয়ে রূপাকে) 
এই সময়ে বাসে ভিড় থাকে না সাধারণত। তাই না চাইতেও আবিরকে বিদায় জানিয়ে বাসে উঠে বসলো রূপা। জ্যামে পড়তে চায় না আপাতত। আজকে বাসে যাত্রী তুলনামূলকভাবে আরো কম, কারণ ঈদের ছুটি। কানে হেডফোন লাগিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে হারিয়ে গিয়েছিল রূপা। মনে আনাগোনা করছিল হাজারো চিন্তা। কাল রাতেই বাবার সাথে দেশের বাইরে পড়তে যাবার কথা বলতে গিয়েছিল। রূপার রেজাল্ট ভালো। ভার্সিটির সব ফ্যাকাল্টিই তাকে বাইরে স্কলারশিপের জন্য চেষ্টা করতে বলে। সে নিজেও চায়, একটু নিজের মত করে দুনিয়াটা দেখতে, বাবা-মায়ের সংস্কারাচ্ছন্ন দুনিয়ার বেষ্টনী ছেড়ে একটু বাইরে উঁকি দিতে। কিন্তু বাবার ঘোরতর আপত্তি। কাল রাতে এই নিয়ে বিশাল ঝগড়া হয়েছে। রূপা বাবাকে যথেষ্ট ভয় পায়, কারণ ছোটবেলা থেকে বাবার কঠোর শাসন। কিন্তু কঠিনের মাঝেও একটা অদ্ভুত মায়া আছে তার বাবার মাঝে। ঝগড়া করতে গিয়ে পারে না রূপা, কেঁদে দেয়। ভেতরে ভীষণ ভালবাসে বাবাকে। শুধু এই গোড়ামীগুলোই সহ্য হয় না। আজ যদি ভাইয়া দেশের বাইরে যেতে চাইতো, আব্বু কিছুই বলতো না। কিন্তু এবার রূপা একদম অটল। যেয়েই ছাড়বে। মনে মনে যতভাবে বিদ্রোহ করা যায়, তা সে করে ফেলেছে। এমন সব চিন্তার ব্যাঘাত ঘটালো মায়ের ফোন। 
মাঃ কই তুই? 
রূপাঃ বাসে
মাঃ কতক্ষণ লাগবে আর আসতে? 
রূপাঃ ২০ মিনিটের মত। 
মাঃ তোর বাবা বলেছে তোকে বাইরে যাওয়ার প্রিপারেশন নিতে
রূপাঃ মানে? সিরিয়াসলি? 
মাঃ হ্যাঁ।
রূপাঃ কিভাবে মেনে গেলো? 
মাঃ তোদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কবে গিয়েছে মানুষটা। শুধু প্রথমেই যত হম্বিতম্বি! 
রূপাঃ (হেসে ওঠে জোরে) 
মাঃ আচ্ছা হয়েছে। তাড়াতাড়ি বাসায় আসো। তোমার জন্য রসমালাই বানিয়েছি। 
রূপাঃ আচ্ছা। 
রূপার ইচ্ছে করছে এখন ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে। এতো খুশি লাগছে রূপার। রবীন্দ্রসঙ্গীত বাতিল করে একটা ঝাকানাকা গান ছাড়লো। হঠাৎ মনে পড়লো ধলেশ্বরী নদীতে নৌকা চড়তে যাওয়ার কথা বন্ধুদের সাথে। কিভাবে যেতে হবে সেই রাস্তাটাই খুজছিলো সবাই মিলে গত কয়দিন। অগ্রগতি কি জানতে শুভকে কল দিলো-
রূপাঃ পাইসিস কিভাবে যাইতে হবে? 
শুভঃ একটা রুট পাইসি কিন্তু এখান দিয়ে জ্যাম পড়বে অনেক 
রূপাঃ তাইলে অন্য রাস্তা খোঁজ! 
শুভঃ দাড়া দেখতেসি।
রূপাঃ আমি দেখতেসি শুনতে পারবো না আর। এই পুরা সপ্তাহ জুড়ে বৃষ্টি থাকবে। আমি চেক করসি। জ্যামনে হোক রুট বের কর। আমার নৌকায় চড়া লাগবে। 
শুভঃ আচ্ছা মা আমার! করতেসি বের। এতো জ্বালাইতে পারিস তুই! আবির যে তোরে ক্যামনে সহ্য করে আল্লা মালুম! 
রূপাঃ জ্বলে খুব? তুই তো শালা সিঙ্গেল। 
শুভঃ তোর মত মেয়েদের ভয়েই সিঙ্গেল। যা রাখ! জানাইতেসি আমি তোকে। 
রূপা ফোন কাটার পরেই খেয়াল করলো বাসটা একেবারে খালি হয়ে গেছে। সেই একমাত্র যাত্রী। সাধারণত এমন হয় না। আজ ঈদের ছুটির কারণে যাত্রী কম। ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। আবির কি সিম ঢুকিয়েছে ফোনে? স্ক্রিনের দিকে তাকানোর আগেই কেউ একজন তার ওড়না ধরে টান দিলো। তাকাতেই দেখলো বাসের কন্ট্রাকটর জ্বলজ্বলে দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। 
কন্ট্রাকটরঃ এতো কিসের কথা ফোনে সুন্দরী? সারাদিন মাগীগিরি তাই না? 
রূপাঃ সমস্যা কি আপনার? 
কন্ট্রাকটরঃ আমার সমস্যা কি হেইডা তুমারে বুঝাইতেই তো আসছি। 
রূপাঃ এই সরেন আপনি। (দাঁড়িয়ে পড়ে)
কন্ট্রাকটর হাত ধরে পেছনের দিকে টানে
রূপাঃ (চিৎকার করে সর্বশক্তি দিয়ে। ড্রাইভার গাড়ী থামান। এই আপনি ছাড়েন আমাকে! কেউ আছেন!!!! হেল্প!!!)
কন্ট্রাকটরঃ কেউ নাইকা (হলুদ দাঁত বের করে হাসে) 
রূপা আশে পাশে তাকায়। রাত হয়ে গেছে কিছুক্ষন আগেই। এই রাস্তাটাও নির্জন। তার চিৎকার কারো কানে পৌঁছাবে না এটুক শিওর। চলন্ত বাস থেকেই লাফ দেবে রাস্তায় চিন্তা করে। হাত পা ভাঙলে ভাঙ্গুক। সামনের দিকে দৌড় দেয় রূপা। কিন্তু হ্যাচকা টানে তাকে পেছনে নিয়ে আসে কনট্রাকটর। বাসটাও থেমে যায় হার্ড ব্রেক করে। হিড়হিড় করে টেনে রূপাকে বাসের পেছনের সিটে নিয়ে আসে ড্রাইভার আর কনট্রাকটর মিলে। বাঁচার জন্য  নিজের টাকা পয়সা মোবাইল সব দিয়ে দিতে চায়। কিন্তু কিছুতেই শেষ রক্ষা হয় না। এতদিন ধরে যেসব ধর্ষণের গল্প পড়তো পত্রিকায় আজকে সেই গল্পেরই প্রধান চরিত্র হয়ে যাচ্ছে রূপা। তীব্র ব্যাথায় তার শরীরটা কুকড়ে যাচ্ছে। চরম দুঃসময়ের মাঝেও কি মানুষের ব্রেইন কাজ করে? এখন দেখা যাচ্ছে করে। রূপার খুব জানতে ইচ্ছে করছে মোবাইলটা ভাইব্রেট করেছিল কেন? আবির কি সিম ঢুকিয়েছে ফোনে? আবির মেসেজ দিয়েছিল? ছেলেটা খুব খুশি হয়েছিল ফোন পেয়ে। ওর চোখে পানি চলে এসেছিলো। কে বলে সুখ দামী? মন থেকে চাইলে সুখ পৃথিবীর সবচেয়ে সহজলভ্য। হাতাহাতি করে বাধা দেয়ার চেষ্টা অনেক আগেই বন্ধ করেছে রূপা। কিন্তু গলার উপর হাতটা চেপে বসতেই মানুষের বেঁচে থাকার আজন্ম স্বভাবে আরেকবার বাধা দেয়ার চেষ্টা করলো, সুবিধা করতে পারলো না। এই কি তবে শেষ? বাসায় গিয়ে বাবাকে একবার জড়িয়ে দেয়ার ইচ্ছাটা পূরণ হবে না? নিজের সব সংস্কার ঝেড়ে ফেলে মেয়েকে দেশের বাইরে পাঠাতে রাজি হলো যে বাবা তাকে একবার নিঃশব্দে ভালোবাসি বলতে পারবে না? ওর ফোনে রিং বাজা শুরু হলো।  চোখে পানি চলে আসছে রূপার। নিশ্চয়ই শুভ ধলেশ্বরীতে যাওয়ার রাস্তা খুজে পেয়ে ফোন দিয়েছে। ফ্রেন্ডগুলা তাকে ছাড়াই ধলেশ্বরীতে নৌকায় বসে মৌসুমী ভৌমিকের "আমি শুনেছি সেদিন" গাবে? আম্মুর রসমালাই? একটা টুকরো গল্পও যে শেষ করে যেতে পারলো না রূপা? 
নিঃশ্বাস ফুরিয়ে আসছে রূপার। একটা সুন্দর ভাবনা নিয়ে চোখ বোজার কথা ভাবলো সে। পাচ্ছে না। একটা প্রশ্নই মাথায় আসছে, হুমায়ূন আহমেদের কোন রূপার কি ধর্ষণ হয়েছে? যুগোপযোগী লেখক হিসেবে তার উচিত ছিল বাংলাদেশের রূপার একটা ধর্ষণের গল্প লেখা। আফসোস! স্যারও নেই লেখার জন্য, রূপাও আর থাকছে না। 
x

Comments

Popular posts from this blog

হসন্ত-২

অচেনা সিম্ফোনি

তোমরা বরং “বংশোদ্ভূত”ই থাকো!