শেষের শুরু

আরিফিন!!  
তুই হলি আমাদের শেষের শুরু। শুনতে খুব অদ্ভুত শোনায় মানি, কিন্তু কথাটা বেমালুম সত্যি। তুই চলে যাওয়াতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে অনেক, তোর জন্য যতটা তার চেয়ে বেশি হচ্ছে এই ভেবে যে আমরা জানি এর পরে আর কিছুই আগের মত থাকবে না। এই কিছুই আগের মত থাকবে না ব্যাপারটা তুই জার্মানি না গেলেও ঘটতো, গেলেও ঘটতো। তাই তোর ভুমিকাটা এখানে পরোক্ষ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। তারুণ্যের বন্ধুত্বে যেই যেই সময়ে ফাটল ধরার কথা তা আমরা সাফল্যের সাথেই উৎরে গেছি। এখনের সময়টা আসলে না চাইতেও দূরে যাওয়ার, না চাইতেও ভুলে যাওয়ার। তুই চলে যাওয়ার ঘন্টা বাজার সাথে সাথে বুঝে গেছি এই পরের মাস থেকে পরবর্তী ৫ বছর আর কিছুই একরকম থাকবে না, এবং তারপর আর কখনো সেটা আগের মত হবে না, এমনকি হয়তো আর কখনো মনমতো হবে না। তুই চলে যাবি একদিকে, আমি চলে যাবো অন্যদিকে, ঊষা আমাদের চলে যাওয়ার পর নিজের হিসেব মেলাবে নিজের মত করে, শুভ ওর ক্রাইসিস মেটাতে মেটাতে ক্লান্ত থাকবে আর রব্বানি হয়তো অন্য আরেক রাফায়েল ভাইয়ের প্যাঁদানিতে থাকবে।
আগে জানলেও জানতে চাইতাম না, বুঝলেও বুঝতে চাইতাম না। এখন বুঝি, কঠিন সত্য এটাই, এরপর কেউ চাকরি করবে, কেউ ব্যবসা, কেউ সংসার আর সবই একে অপর থেকে ভীষণ দূরে থেকে। কেউ হয়তো আর বাংলাদেশেই থাকবে না। বাচ্চার স্কুল, অফিসের এসাইনমেন্ট, বসের তাড়া, স্বামীর সাথে একটা সন্ধ্যা কাটানো, অনেকদিন দেখতে না যাওয়া মায়ের কাছে একটা রাত থাকা, স্ত্রীর অনেকদিনের জমে থাকা রাগ বাষ্পীভূত করার ফাঁকে নিজের অজান্তেই আমরা নিজেরা নিজেদের থেকে হারিয়ে যাবো। দেখা হবে, অনুষ্ঠানে, দাওয়াতে, হয়তো নিজেরাও দেখা করবো। কিন্তু এই যে এতদিনের একটা নিষ্পাপ সম্বল, এটুক থাকবে না। এইযে কই তুই বললেই ৩০ মিনিটের নোটিসে চোখের সামনে হাজির হয়ে যাচ্ছি, একবার বাস মিস করে পরেরবার আবার জমিদারবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছি, জমিদারবাড়ি বন্ধ থাকায় পূজার খাবার কলাপাতায় খেয়ে খ্যালখ্যাল করে হাসছি, হেড়ে গলায় গান গাচ্ছি, পণ্ডিতের মত তোর আত্মবিশ্বাসের সাথে গেয়ে যাওয়া ভুল লিরিক্স শুনে ভ্রূ কুঁচকে তাকায় থাকছি, তোর ডানাকাটা পরী আর দইফুচকার ভিডিও দেখে হাসতে হাসতে কেঁদে দিচ্ছি এগুলো থাকবে না। শুধু  হয়তো অনেকদিন পর পর 'উই নীড টু টক' বলে আমাকে তুই একটা ফোন দিয়ে বসবি, হয়তো 'মুভি দে দোস্ত' বলে অল্পসল্প জ্বালাবি। সম্পর্কটা হয়তো আটকে যাবে চ্যাটবক্সের ঐ আয়তাকার উদ্ভট বক্সের আসামীর মতন। অভিযোগ করছি না, আফসোস করছি। কেন জীবনটা এই স্টুডেন্ট লাইফের মত পলকা মেঘের মত হলো না, কেন জীবনটা অর্ণবের 'হোক কলরব, ফুলগুলো সব লাল না হয়ে নীল হলো ক্যান- টাইপ হলো না?

আমি জানি এসব শোনার পর সান্তনার বাণীগুলো হবে রেডিমেড কার্ডের মাঝে টানা হরফে লেখা কোটেশনের মত। আমাদের ভেতরের টান আগের মতই থাকবে, এই ভালোবাসা আগের মতই থাকবে। এতোকিছুর মাঝেও যে এক দুইদিন দেখা হবে তাতেই অনেক শান্তি লাগবে। এসবই আমি জানি, শুধু মানি না। কারণ বাস্তবতা কোন ধ্রুব কিছু না। বাস্তবতার জন্মই হয়েছে মানুষকে নিত্যনতুন উপায়ে আঘাতের জন্য তৈরি করাতে। তাই খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলছি, তুই চলে যাবার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না। এরপর থেকে ধীরে ধীরে শুরু হয়ে যাবে, হারিয়ে যাওয়ার গল্প কিংবা বড় হয়ে যাওয়ার গল্প কিংবা ক্রমে কিন্তু দ্রুতই ক্ষয়ে যাওয়ার গল্প। শুরু হয়ে যাবে বার্ধক্যের আগের ধূসর গল্প।

সুতরাং, তোর চলে যাওয়া আমাদের শেষের শুরু, এই মুক্ত বিহঙ্গের মত জীবনের সমাপ্তির প্রথম পর্ব শুরু। জীবনে প্রেমটা হলো মুচকি হাসি, আর বন্ধুত্ব অট্টহাসি। সমস্যা হলো, ভীষণ চাইলেও এই অট্টহাসি বেশিদিন জোরে হাসা যায় না।  
ইতি 
অন?? 

Comments

Popular posts from this blog

হসন্ত-২

অচেনা সিম্ফোনি

তোমরা বরং “বংশোদ্ভূত”ই থাকো!