তোমরা বরং “বংশোদ্ভূত”ই থাকো!
একটা
পুরনো প্রবাদের বাংলাদেশী সংস্করণ বলি, “গেয়ো যোগী ভিগ পায়
না, আর যখন অন্য দেশে গিয়ে ভিগ পায় তখন বাংলাদেশীরা যোগীকে নিজের
মনে করে।” ধর্ম বাদে অন্য যেকোনো
বিষয়ে বাংলাদেশীদের ক্ষেত্রে এই প্রবাদ গ্রহণযোগ্য।
নিজের সম্পদ বিকিয়ে দিয়ে তাকেই আবার সম্পত্তিরূপে গণ্য করা বাঙ্গালিদের আজন্ম
স্বভাব।
কথাগুলো
বলছিলাম মার্গারিটা মামুনের অলিম্পিকে স্বর্ণ পদক জয়ের প্রেক্ষাপটে। পৃথিবীতে ৭৫টি দেশ আছে যাদের পকেটে অলিম্পিকের
স্বর্ণপদক জোটেনি এখনও। এর মধ্যে আমার সাধের বাংলাদেশও আছে। বাংলাদেশ অলিম্পিক
জেতেনি, না জিতেও আরও অনেক দেশোদ্ধারমূলক কাজ করেছে, সেই জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় আমরা
আপাতত না যাই। কথা হচ্ছে, যখনই “বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত” মার্গারিটা মামুন রাশিয়ার
হয়ে পুরস্কার জিতে নিলেন তখনই শুরু হলো তাকে নিয়ে বঙ্গ-বন্দনা। হুজুগে বাঙালি
পারলে আর কোন মুকুট না পেলে লাক্স চ্যানেল আইয়ের মুকুট নিয়ে পড়িয়ে দেয়
মার্গারিটাকে। একবার আমাকে বলবেন, মার্গারিটা আমাদের কিভাবে হলো?
রামপাল,
বায়োমেট্রিক সিম নিবন্ধন, মুসলিম রাষ্ট্র- সব আমাদের হতে পারে, মার্গারিটা না। একবার
চিন্তা করে দেখুনতো, মার্গারিটা যদি আমাদের দেশে বেড়ে উঠতো
তার ভাগ্যে কি অলিম্পিকের স্বর্ণপদক থাকতো? আর দশজন সাধারণ
মেয়ের মতো তাকেও সমাজের ঘেরাটোপে আটকে যেতে হতো, পাশের বাসার আন্টি কি বলবে এই ভয়ে
জিমন্যাস্ট হওয়ার স্বপ্ন ফরেনসিক মেডিসিন কিংবা সার্কিটের মাঝে জলাঞ্জলি দিতো।
কিংবা কে জানে হয়তো তার যে জিমন্যাস্ট হওয়ার স্বপ্ন আছে তাও বুঝতে পেতো না।
পড়াশোনা শেষ করে প্রতি রাতে স্বপ্নের বদলে ভাত রেঁধে হাতে রিমোট নিয়ে স্টার জলসা
আর জি বাংলায় চোখ ঘোরাতো। ফেসবুকে মার্গারিটাকে নিয়ে একটি ট্রল বেরিয়েছে, তাতে
লেখা-আমার ভাগ্য ভালো যে বাবা বিদেশ গিয়েছিল তাই আমি জিমন্যাস্ট হতে পেরেছি। নাহলে
এখন আমাকে ফার্মগেটে মেডিকেল কোচিং এ দৌড়াতে হতো।” খুব ভুল বলেছে?
এই
দেশে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-উকিল ছাড়া নামে মাত্র বাকি কিছু পেশার স্বীকৃতি মিলেছে এক
দশক মাত্র। আধুনিকতার শিরদাঁড়া খাড়া করে এখন বলতেই পারেন নারীরা অনেক এগিয়ে গেছে,
সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। মানলাম না হয় করছে। কিন্তু একজন নারী যে
ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-উকিল ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে সেটা ভেবেছেন? স্বপ্ন কিংবা
সুযোগ সব না হয় বাদ দিলাম। এই দেশের মেয়ে এই পোশাক পড়ে বাইরে খেলতে গেলেই তো দেশের
মানুষ ধর্মের নামে ভার্চুয়ালি মার্গারিটার কতল করে ফেলতো। যেই মানুষটার স্বপ্নের
ভার এই জাতি নিতে পারেনি, স্বপ্ন লালনের
পরিবেশ দিতে পারেনি সে কি করে আমাদের হয়?
আমরা
রত্ন চিনতে ভুল করলেও, রত্ন তার শেকড় ভুলে যায়নি। মানুষটা এই দেশের ধুলো মাটি গায়ে মেখে
বড় হয়নি, তার গায়ে এই দেশের বৃষ্টি ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ লেগে নেই, তবুও সে
এসেছিলো বাংলাদেশের হয়ে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করতে। কিন্তু চার বছর আগে বাবার সাথে
এসে বাংলাদেশে সুযোগ চাইলেও ফেডারেশন সহায়তা করেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জিমন্যাস্টিক
ফেডারেশন ও বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনে (বিওএ) যোগাযোগ করলেও কোন সহযোগিতা
মেলেনি। কর্মকর্তাদের মতে, তাকে দেয়ার মতো সুযোগ সুবিধা তখন বাংলাদেশের ছিল না।
আমাদের কাছে তাকে দেয়ার মতো সুযোগ সুবিধাও ছিল না, আমরা তৈরি করার আশ্বাসও দেইনি তাকে,
আর আপনারা বলছেন মার্গারিটা আমাদের মেয়ে?
মার্গারিটা
মামুনের উইকিপিডিয়ার পেইজ দেখেছেন? তার অর্জনের লিস্ট দেখেছেন? এই দেশে থাকলে তার
এমন কোন পেইজের অস্তিত্ব থাকতো না। একই কথা খাটে আরেক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত নাদিয়া
জামির হুসাইনের ক্ষেত্রে যে কিনা বেকিং কম্পিটিশনে প্রথম হয়ে সবার নজর কেড়েছেন।
আরও বিশদাকারে আলোচিত হয়েছেন রাণী এলিজাবেথের জন্মদিনের কেক বানানোর সুবাদে।
বাংলাদেশে থাকলে তার স্বপ্নের প্রত্যুত্তর হতো- কেক বানানো কোন প্রতিভা হল? এতো
সবাই পারে। এই হচ্ছে প্রতিভাবানের প্রতি বাঙালির প্রতিক্রিয়া। আর আমাদের
হ্যাশট্যাগ গর্বে ভরে যায় প্রতিবার যখন কোন “বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত” পুরস্কার পেয়ে
বিশ্বমানচিত্রে জায়গা করে নেয়। আমরা সত্যিই পারিও বটে!
এই
দেশ হচ্ছে আগাগোড়া ঘাতকের দেশ। রাজনৈতিক কিংবা সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞেরও বহু আগে
থেকে এই দেশে মানুষ হত্যা চলছে, অভিভাবকত্বের নামে, “সমাজ কি বলবে” এই শিরোনামের
আড়ালে! আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার যথার্থই বলেছেন, “আমাদের অভিভাবকেরা একেকজন
প্রতিভার ঘাতক, যে ছেলেমেয়ের আইনস্টাইন হওয়ার কথা, বাবা-মা তাকে বানাতে চান
ইঞ্জিনিয়ার, যার রবীন্দ্রনাথ হওয়ার কথা, অভিভাবকেরা তাকে বানিয়ে ফেলেন ডাক্তার।”
তাই মার্গারিটা “বাংলার বাঘিনী” হলেও তাকে সেই নামে ডাকার যোগ্যতা জাতি হিসেবে
আমাদের নেই। তার অর্জনে আনন্দিত হলেও, তাতে ভাগ বসানোর অধিকার আমাদের নেই। অলিম্পিক
কেন, দুনিয়ার আরও বহু জায়গায় সম্মানের সাথে আমার দেশের নাম থাকতে পারতো, কিন্তু
আমাদের অজ্ঞতার জন্য পারেনি। যোদ্ধা হিসেবে আমরা যতটা সফল, জাতি হিসেবে আমরা ততটাই
ব্যর্থ। “স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা ধরে রাখা কঠিন” এই উধ্বৃতির সবচেয়ে বড়
উদাহরণ বোধহয় বাংলাদেশ। তাই মার্গারিটা, নাদিয়াদের বলি, “তোমরা বরং বংশোদ্ভূতই
থাকো!”
২৭.০৮.২০১৬
Comments
Post a Comment