অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ

লাবণ্য ঠোঁট খুঁটছে। ছোটবেলায় অনেক বেশি তিন গোয়েন্দা পড়ার শখ ছিলো। কিশোর পাশা ছিলো পছন্দের চরিত্র। কিশোর খুব চিন্তায় থাকলে ক্রমাগত ঠোঁট খুঁটতে থাকতো। অভ্যাসটা লাবণ্যও রপ্ত করেছে, নিজের অজান্তেই। আজ সে ভীষণরকমের চিন্তিত আর কিছুক্ষণ পরই কাজী আসবে লাবণ্যের সই নিতে। তার আর আরেফিনের বিয়েটা পারিবারিকভাবেই ঠিক করা হয়েছে। একসময় প্রেম, বিয়ে এসবের প্রতি একটা অন্যরকম টান কাজ করতো এখন আর সেসব কিছুই নেই। আগুন কয়লায় পোড়া জীবনে এসব শখ কর্পুরের মত উড়ে গেছে। 

খুব বাস্তববাদী হয়ে গেছে এখন লাবণ্য। ব্যর্থ প্রেমগুলো থেকে এটুকু বুঝেছে সম্পর্কে ভালোবাসা যতই থাকুক নারী নারী আর পুরুষ পুরুষই থাকে। ছোটবেলা থেকেই সে অনেক একরোখা স্বভাবের ছিলো, অন্যায় সহ্য করতে পারতো না, আর মেয়ে বলে অসমতা তো কখনই পারতো নাকখনো মা তাকে ঘরের কাজ করতে বললেই  লাবণ্যের প্রশ্ন থাকতো, “কেন ভাইয়া বাসার কাজ করে না”? একসময় মা বলতেন, “ও তো ছেলে। ও কেন এসব কাজ করবে এসব তো মেয়েদের কাজ”।  ধীরে ধীরে আরো নিয়ম দেখতে থাকলো সে। মেয়েদের ব্যাগ হাতে নিয়ে দাড়ালে ছেলেদের আত্মসম্মানে লাগে, রান্না করাটা মেয়েদেরই শেখা বাধ্যতামূলক বিয়ের আগে ছেলেদের নয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। মায়ের কথার উত্তরে একসময় চুপ করে থাকলেও বড় হওয়ার পর আর থেমে থাকেনি।  

ফেমিনিজমের বুলি কখনই কপচায়নি লাবণ্য, তবে মানুষ হিসেবে ছেলেমেয়ে সবারই একটা সাধারণ অধিকার থাকা উচিত। এইটুকু যুক্তি খাটিয়েই চলতে চেয়েছিল সে। কিন্তু নিজের ভালোবাসার মানুষটাও যখন খুব দম্ভের সাথে বলে বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িই তোমার বাড়ি তখন আর নিজের মায়ের সাথে তর্ক করার আগ্রহটুকুও হারিয়ে গেলো। অথচ এই মানুষটার প্রেমে পড়েছিলো গণজাগরণ মঞ্চে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবিতে শ্লোগান দিতে দিতে। অল্পদিনেই মানুষটার আধুনিক চিন্তা চেতনার প্রেমে পড়ে গেলো লাবণ্য। দুনিয়ার হেন কেন তত্ত্ব নেই যা মানুষটা জানে না। মুগ্ধ হয়ে মানুষটার কথা শুনতো সে। কিন্তু দিনের শেষে কোন পুরুষই বোধহয় এই তাদের  সামাজিক “তান্ত্রিকতা” ছাড়তে পারে না। তাইতো বিয়ের পরে এনজিও এর চাকরি ছেড়ে শিক্ষকের চাকরি নিতে অনুরোধ করেছিল তার প্রেমিক পুরুষটি। তাহলে সংসারে সময় দিতে পারবে এই ছিল তার যুক্তি। লাবণ্য সবসময় ভাবতো সোডিয়াম আলোতে সব মানুষকে অনেক সুন্দর দেখায়। কিন্তু সেদিন সোডিয়াম আলোতে খুব বীভৎস লাগছিলো শুভ্রকে।


বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিলো অনেকদিন থেকেই, শুভ্রর সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার পর লাবণ্য আর বেশিদিন সময় নিতে পারেনি। একের পর এক ছেলে দেখা শুরু হয়ে গেলো। ব্যতিক্রমী শিক্ষিত পুরুষই যখন সামাজিক চিন্তার চৌকাঠ পার করতে পারেনি, তখন বাবা-মায়ের খুজে আনা মানুষ আর কদ্দুরই বা ব্যতিক্রম হবে। বিয়েটাকে সবজি গেলার মতন করে গিলে  ফেলার প্রস্তুতি নিয়েছে লাবণ্য। কিন্তু এই মাহেন্দ্রক্ষণে, যখন কাগজেকলমে স্বীকৃতির প্রশ্ন আসছে তখনই চিন্তার গোলকধাঁধায় পড়ে যাচ্ছে লাবণ্য। আরেফিন পুরোদস্তুর কমার্সের মানুষ, সাহিত্য কিংবা কোন তত্ত্বজ্ঞানের মধ্যে সে জীবনে কখনও ছিলো না, আর থাকার সম্ভাবনাও নেই। এসব সমতার ব্যাপারে তার মাথা ঘামানোর কথাও নয়। আর যেই ছেলে না জেনেই শুধু চোখের দেখায় কাওকে বিয়ে করতে রাজি হতে পারে তার চিন্তার দৌড় কতদূর তা লাবণ্য হিসেবও কষতে চায় না। লাবণ্যকে তার মা একবার জিজ্ঞেস করেছিল বিয়ের আগে পরিচিত হতে চায় কিনা। লাবণ্য আগ্রহ দেখায়নি। বিয়ে পুরো বিষয়টা নিয়েই তার মন একেবারে বিষিয়ে আছে। আরো পরিচিত হয়ে সেটা বাড়াতে চায়নি। দরজায় টোকা পড়াতে চিন্তায় ব্যাঘাত পড়ল কাবিনের কাগজ নিয়ে কাজী উপস্থিত
কাবিনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে লাবণ্য তার একসময় খুব শখ ছিলো, তার জামাইয়ের নামটা খুব কাব্যিক বাংলা নাম হবে আকাশ, কাব্য, অভ্র এমন কিছু, অথবা রবি ঠাকুরের শেষের কবিতারলাবণ্যর প্রেমিকের মতন অমিত? ধ্যাত ছাই! আরেফিন একটা নাম হলো? একটা কিছু যদি ভালো লাগতো লোকটার! সই শেষ করে খাতাটা এগিয়ে দিলো লাবণ্য


বিয়ের অনুষ্ঠানে আরেফিন অনেকবার চেয়েছে লাবণ্যের সাথে সহজ হতে। পারেনি। লাবণ্যর আড়ষ্টতা দূর হয়নি কিংবা বিরক্তি কমেনি। যতটুকু না করলেই নয় ততটুকু করেই লাবণ্য চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলো। সে শুধু ভাবছিলো এভাবে কিভাবে তাদের বাবা-মায়েরা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করেই সুখের সাথে এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলেন? সুখ কি তারা জীবনে আদৌ বুঝতে পেরেছিলেন? নাকি অভ্যাসকে ভালোবাসা ভেবে আর প্রয়োজনকে সুখ ভেবে জীবন পার করে দিয়েছেন? এসব লাবণ্য কি ভাবছে? আজকের দিনে অন্তত তার এসব ভাবার কথা নয়।


আধুনিক কন্যাদানের সময় উপস্থিত। লাবণ্য মনে মনে হেসে উঠলো। স্টেজ থেকে নামতে গিয়ে গাউনটা সামলাতে খুব ঝামেলা হচ্ছিলো। আশেপাশে কাজিনদের কাওকে দেখতেও পেলো না সে। “আমি ধরছি আপনি নামুন”-পেছন থেকে আরেফিনের শান্ত গলা। লাবণ্য অবাক হয়ে পেছনে তাকালো। স্টেজের সামনে শত শত মানুষের সামনে স্ত্রীর গাউনের পাড় ধরে দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা, আন্তরিক এবং খুব স্বভাবসুলভ হাসি নিয়ে। একটুও দ্বিধা নেই চোখে তার। নিঃশ্বাস আটকে সামনে আগালো লাবণ্য। গাড়িতে ওঠার সময়ও তার পায়ের কাছে গাউনটা গুছিয়ে দিলো আরেফিন। পেছনে মুরিব্বিরা বিদ্রুপ করছিলেন কিছুটা অবশ্যই। কিন্তু মানুষটাকে এ ব্যাপারে খুবই নির্বিকার দেখালো। অনেকক্ষণের চেপে রাখা গোপন দীর্ঘশ্বাসটা লাবণ্য এতক্ষণে ছাড়লো। তার আজন্ম গড়ে তোলা চিন্তাচেতনা সবই তবে ভুল। কয়েক মুহূর্তে মানুষটা বুঝিয়ে দিলো শুদ্ধতার কোন তত্ত্ব নেই, আদর্শের কোন সাহিত্য নেই। হাজার আদর্শ আর নীতিগত বুলি আওড়ানোর পরেও যেই সম্মানটুকু তার প্রেমিক পুরুষ দেখাতে পারেনি, মানুষটা সেটাই দেখিয়ে দিলো। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজেই কিভাবে বাবা-মায়েরা এত বছর সুখের সাথে উৎরে গেলেন সে রহস্য পরিস্কার হওয়া শুরু করলো তার কাছে। এতক্ষণে একটা আলতো হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটের কোণায়। মনের খুব গভীর থেকে, সকল কষ্ট নিগড়ে এই হাসিটুকু এসেছে লাবণ্যর।


গাড়ি চলা শুরু করেছে, মানুষটা খুব সাহস করে একটা হাত রেখেছে লাবণ্যর হাতের উপর। লাবণ্য আরও সাহস করে হাতটা ধরলো নিজের হাতের মুঠোয়।     

    

Comments

  1. আমাকে(আমার নামটা আরকি) এভাবে ভিলেন বানানো কি ঠিক হয়েছে? 😅

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

হসন্ত-২

অচেনা সিম্ফোনি

তোমরা বরং “বংশোদ্ভূত”ই থাকো!