সভ্যতা জরাগ্রস্ত ভাত কিংবা ডালের হিসেব
বাংলা সাহিত্যে ভীষণ বৃষ্টি আর রোদের উদাহরণ দিতে সবসময় কাকের ব্যবহার হয় কেন? তৃষ্ণার্ত কাকের মতন কিংবা কাকভেজা! কাক বোধহয় এই বাংলার সাহিত্যাকাশে পাখি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি! সে যাই হোক। আপাতত আমি কাক-গরম অবস্থায় সেদ্ধ হচ্ছি আর মনেপ্রাণে একটা ভালো খাবারের দোকান খুঁজছি।
দলবেঁধে সকাল বেলা উদ্দেশ্যহীনভাবে চলে এসেছি সোনারগাঁও পানাম সিটিতে। একদম মাঝারি ধরণের অনেকগুলো জমিদার বাড়ি আর উদার সূর্যের আপ্যায়নে অতিশয় আহ্লাদিত হয়ে যখন পেটপূজার রসদ খুঁজছি সেই মুহূর্তে একজন দোকানদার যেচে এসে একটা দোকান দেখিয়ে দিলেন। দোকানের সুনাম এজন্য যে এখানে ঘরের রান্না পাওয়া যায়। আর উপায় না পেয়ে সেখানেই বসে গেলাম উদরপুর্তি করতে। ইটকাঠ পাথরের শহরের গ্যাসের চুলার রসালো খাবারের মাঝে ভুলেই গিয়েছিলাম লাকড়ির চুলায় রান্না অন্যরকম হয়। সেই রকমটার বর্ণনা আমার কলম দিয়ে ঠিক জমে উঠবে না, জমাতে হলে হয় সেকালের রবিবাবুকে লাগবে না হয় একালের সৈয়দ মুজতবা আলীকে। সেই ভুলে যাওয়া খাবার পেটে চালান করে দিয়ে যখন বিল দিতে গেলাম তখন বৃদ্ধ মালিক আমাদের ডালের দাম রাখলেন না। কেন জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, "আপনেগো যেই ভাত দিসি সেইগুলান তো পুরাটা খান নাই। বাইচা গ্যাসে তো। তাই আর ডাইলের টেহা নিলাম না"। টাকা সাধার পরেও বললেন, "কয় চামুচ ডাইল খাইসেন। এইডার আবার কি টেহা দিবেন?" আমি তার কথার উত্তর দিতে পারিনি, প্রতিউত্তর ব্যাপারটা বড্ড এলেবেলে!
আমি আগাগোড়া কর্পোরেট দূষণে জরাগ্রস্ত শহরে বেড়ে ওঠা এক মানুষ। এই জীবনে যতবার দামি রেস্টুরেন্টে খেতে গেছি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি টাকা গচ্চা দিয়েছি ইচ্ছার, অনিচ্ছায় অথবা সস্তা লোক দেখানোর স্রোতে। ১৫টাকার পানি ১০০টাকা দিয়ে খেয়েছি, ৪ জনের খাবার বলে একজনের খাবার দিলে ভেবেছি এটাই বোধহয় মর্ডান নিয়ম, খাবারের সাথে সসটা আলাদা টাকা দিয়ে কিনে খেয়েছি কোন প্রতিবাদ ছাড়া। পাই পাই করে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি দাম ভরেছি সবসময়। কখনো মাথায় আসেনি কেউ এতটুকু সততা নিয়ে ব্যাবসা করতে নামতে পারে। এমন বুর্জোয়া আস্তাকুড়ের সদস্য আমি যে ধরেই নিয়েছি ব্যাবসা করতে নেমেছে মানেই সততা শেষ!
পেট আর মন উভয়ের তৃপ্তি নিয়ে যখন বের হয়ে আসছিলাম পেছন থেকে বৃদ্ধ কথা বলা শুরু করলেন, "খাওনের ব্যবসা আমার নতুন না কিন্তুক! নিজের হাতে যুদ্ধের সময়ে এইই লম্বা পাটি বিসায়া মুক্তিযুদ্ধাগো খাওয়াইসি। দলে দলে সব্বাই আইতো, আমার এইহানে খাওনের লাইগা। পাকিগো কাস থেইকা লুকাইয়া লুকাইয়া খাওয়াসি।"
ঘুরে তাকালাম মানুষটার দিকে। ডালের টাকা দিতে চাওয়াতে বোধহয় একটু কষ্ট লেগেছে আজীবন আপ্যায়ন করে অভ্যস্ত মানুষটার। খুব আমোদ করে গল্প করা শুরু করলেন। তার পরিবার, ছেলে আর তার ছোট্ট জীবনের বৃহৎ বৃহৎ গল্প।
অতি সুখ কিংবা দুঃখের অনুভূতির মাঝে একটা অদ্ভুত মিল আছে। দুটোর শুরুতেই একটা শুন্য, ভোঁতা অনুভূতি কাজ করে। সেই অনুভূতি নিয়েই বাসে উঠে বসলাম। মুক্তিযুদ্ধের এমন হাজারো গল্প আছে, এর চেয়েও কঠিন, প্রখর অথবা জীবনচেরা গল্প আছে। সম্মুখে থেকে যুদ্ধ করেননি এমন মানুষের সংখ্যাটা হয়তো শহীদদের চেয়েও বেশি হবে। তাই মুক্তিযোদ্ধা আর গৌরবের পেছনে মলিন হয়ে যাওয়া এই মানুষদের পরিণতির কথা বলে উচ্চ মার্গীয় পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গল্প উপস্থাপন করতে চাচ্ছি না। শুধু ভাবছি, অল্প কত কিছুতে বিরক্ত হয়েই তো এখন আমরা হাল ছেড়ে দেই, নিজের জীবন দিয়ে দেই অথবা অন্যের জীবন নিয়ে নেই। আর এই মানুষগুলো নিজের সবটুকু দিয়ে স্বাধীনতার আন্দোলনে একাত্ন হয়েছিলেন। কিন্তু দেশ তাদের কিছুই দেয়নি, না অর্থনৈতিক সাহায্য, না স্বীকৃতি। উনাদের এতো মুল্য দিয়ে কেনা স্বাধীন দেশে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে বুলেট প্রুফ আর ভ্যাট্মুক্ত জীপ গাড়িতে করে কৃতি সন্তানেরা ঘুরে বেড়ায়। তাও তাদের চোখে একচেটিয়া দুঃখের বসতি নেই। তবুও মানুষগুলোর হাসি আটকে যায় না, গৌরব ম্লান হয় না, সাহস কমে না কিংবা হতাশ হয় না। নিজের স্বপ্ন বিলীন হতে দেখেও পান খাওয়া হলুদ দাঁত বের করে এমন ক্লোজআপ মার্কা হাসি দেখেই বোধহয় নচিকেতা গেয়েছিলেন, 'স্বপ্নের বেচা কেনা করাই জীবন, দেয়ালে ঠেকলে পিঠ লড়াই জীবন।
এখন বুঝি কেন ঈশ্বর থাকেন ভদ্রপল্লীতে, আর জীবন থাকে ধুলোমাখা রাস্তার ধারে!
বড় ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে। আপনার শহলে গেলে এই মুরব্বির ঠিকানাটা নিয়া যামু। খাই না খাই এই হোটেলে কিছু সময় বসলে ভালো লাগবে...
ReplyDelete