সময়ের আফসোস

আমি প্রতিদিন সকালে ভার্সিটি যাওয়ার সময় গাড়ি যখন বিজয় সরণী মোড়ে থামে, ঠিক সেই সময় আমার ড্রাইভারের একটা ফোন আসে। আমার ড্রাইভার সাধারণত গাড়িতে ফোন ধরে না, কিন্তু এই ফোন ধরে। খুব আগ্রহ নিয়ে ধরে। ঐ পাশ থেকে একটা আবছা চিৎকার ভেসে আসে-আব্বু!
ড্রাইভার-হ্যা আব্বু?
ওপাশ থেকে কিছু ইনিয়ে বিনিয়ে কথা।
ড্রাইভার-স্কুলে যাইতেসো আম্মা?
অপর পাশে হ্যা বা না কিছুই আমি শুনতে পাই না।
ড্রাইভার: আইচ্ছা। রাস্তার এক সাইড দি যাইও। দেখি দেখি যাইও কেমন? আব্বু গাড়ি চালাইয়ের। রাখি কেমন?
আমার ড্রাইভার খুব লজ্জা লজ্জা স্বরে বলে আপা আমার বড় মেয়ে। এই বচ্ছর প্রথম স্কুলে জাইতেসে। রওনা দেওনের আগে আমারে একবার ফোন দেয়। না ধইরলে খুব মন খারাপ করে। এই বলে গাড়ি চালানোয় মনযোগ দেয় সে।
আমি মানুষটার ঠোঁটের কোণায় তাকিয়ে থাকি। আলতো তৃপ্তির হাসিটা মোছে না তার মুখ থেকে। আজকাল আমি অনেকটা অপেক্ষা করেই থাকি মেয়েটার ফোনের জন্য। পুরো কথোপকথনে আমি 'আব্বু' ছাড়া বিশেষ কিছুই শুনতে পাই না। কিন্তু পুরো সময় জুড়ে আমাকে ঘিরে থাকে এক অদ্ভুত ইথার-ভালোবাসা।
বাবা-কন্যার ভালোবাসার এই রূপটুকু দেখে আমার কি আফসোস হয় কোন? নাহ। এমন দিন আমারও ছিল। এখনও মনে পড়ে প্রতি সাময়িকের পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে রেডি হয়ে আব্বুর রুমে যেতাম। ভীষণ গর্জন করে নাক ডাকতো আব্বু। আমি কানের কাছে খুব আস্তে আস্তে ডাক দিতাম। যেই নাক ডাকা থামতো বুঝতাম তার ঘুম ভেঙ্গেছে। আজীবন চিৎকার করে কথা বলা মানুষটা ঐ একটা সময়ে আস্তে করে বলতো, ‘আচ্ছা আম্মু, যাও। ভালো করে পরীক্ষা দিও’। এই অভ্যাসের ব্যতিক্রম কবে ঘটেছে টের পাইনি, আর এর অস্তিত্ব যে বিলীন হয়েছে তা এতদিনে বোধ করলাম। এটাকে কি আফসোস বলে?
আমি এখন কয়েকমাস পর পর সেমিস্টার ফাইনাল দেই, পরীক্ষার আগে আমার মাঝে মাঝে নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়, আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে  কাঁদি, বইপত্র ছুড়ে ফেলি, আবার সব সামলে নিয়ে পড়তে বসি। এর কোন কিছুই এখন আর বাবা মা টের পায় না। কারণ এসব মামুলি বিষয়ে মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানদের ভাগ্যে সান্তনা বরাদ্দ নেই। পড়াশোনা নিয়ে হতাশা এসব পরিবারে বিলাসিতা। আগে ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখে কাঁদলে আব্বু হাটুর উপর বালিশ দিয়ে আমাকে শুইয়ে ঘুমের মধ্যে গান গাইতে গাইতে কান্না থামানোর চেষ্টা করতো। এখন আমি ঘুম ছাড়া বাস্তবে কাঁদলেও সেখানে আব্বুর প্রবেশাধিকার নেই। কারণ বড় হলে ছোটখাটো ব্যাপারে কাঁদতে নেই।

আমার ড্রাইভারের মেয়েটাকে হিংসা হচ্ছে, ভীষণ! এটাকে কি আফসোস বলে? বলে হয়তো। সময়ের আফসোস। আমার তাহলে আফসোস হচ্ছে খুব। আচ্ছা এই আফসোসের জন্য কি কাঁদা যাবে? এই কান্না কি সবার কাছে গুরুগম্ভীর এবং গুরুত্বপূর্ণ কান্না হিসেবে বিবেচিত হবে? এই কান্না কি আব্বুকে দেখানো যাবে? হাটুর উপর শুয়ে কান্না থামানোর গান শোনা যাবে?  

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

হসন্ত-২

অচেনা সিম্ফোনি

তোমরা বরং “বংশোদ্ভূত”ই থাকো!