অতিব্যস্ত অনাহূত

মাঝ রাত্তিরে বুকের কষ্ট রক্তে ছড়িয়ে গেলে খুব আরাম হয়। গলা পর্যন্ত আটকে থাকা বুর্জোয়া কান্নাগুলো আহ্লাদি শুয়োপোকার মতন দিকভ্রান্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, পুরো শরীরে, অনেকটা কিংবা পুরো হিরোইনের মত। মনে মনে বলি, যাক শালা! কষ্টের সুষম বণ্টন হলো তবে! ক্লান্ত ময়রার মত দুঃখগুলোকে মাছি মনে করে এদিক ওদিক থেকে সরাতে থাকি। ঠিক যেমন শওকত আলী বলেছিলেন দীর্ঘদিনের শোকে হাহাকার থাকে না, তেমনি বিষাদবিহীন কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছি পুরো শরীরে ক্যান্সারের মত, নাকি এইডসের মত?

তলপেটের নিচটায় প্রায়ই একরকম শিরশিরে অনুভূতি হয়, মনে হয় কোন বিশালাকার সরীসৃপ আমার চামড়ার সর্বস্ব চেটে এগিয়ে চলছে। আমার ভীত সন্ত্রস্ত তলপেট জাগ্রত হয়ে ওঠে, মুহূর্তের মাঝে, এমনকি ঘুমের মাঝেও। সেই চামড়ায় লেপ্টে থাকা জাগ্রত অনুভূতিটা জিতেন্দ্রিয়ের মত এগিয়ে যেতে থাকে আমার যোনিপথের দিকে। হ্যাঁ, এই নামেই চিনেছিলাম একে। তবে চেনার বহু আগেই জেনেছিলাম, দেখার অনেক আগেই বুঝেছিলাম। চামড়ার মাঝে জলন্ত সিগারেট ঠেসে ধরার মত একটা অনুভূতি হয়। জ্বলাটা ওখান পর্যন্ত থাকলেও হতো, কিন্তু থাকে না। অবাধ্য স্রোতের মত শিরা-উপশিরার মধ্য দিয়ে ওপরে উঠতে থাকে। মাঝে মধ্যে মিশে যায় আমার সুষম বণ্টন করা কষ্টগুলোর সাথে। শুকনো বাতাসে আগুন যেমন দাবানলে পরিণত হয় তেমনি আমার রক্তকণিকাগুলো ডাক পিয়নের মত বয়ে নিয়ে যায়, জ্বলার অনুভূতিটাকে, চালান করে দেয় মস্তিষ্কে। মাধ্যমিকের বায়োলজি বইয়ে পড়েছিলাম নিউরনের কাজ হলো পরিবেশ থেকে উদ্দীপনা নিয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছানো। যত্তসব গাঁজাখুরি! এসব হলো ক্ল্যাসিক ইমোশনের ঝান্ডাকে র‍্যাশনালাইজ করার ব্যর্থ চেষ্টা! মনের বায়োলজি বড্ড এলেবেলে, সেখানে অন্য কোন তর্ক চলে না। এই যে আমি। বাইরের কোন উদ্দীপনা ছাড়াই আমার নিম্নাঙ্গ থেকে আগুন ধরিয়ে দেয়া এক অনুভূতি ছুটে আসে মস্তিষ্কে, কড়া নাড়ে অতিব্যস্ত অনাহূতের মত।

আমার মস্তিষ্ক স্মৃতির দরজা খোলে, ওয়েলস সাহেবের টাইম মেশিনে করে পার হয়ে যায় কয়েক বছর। গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির মত নিউরন এসে পড়ে ৫ বছর আগের আমার দরজার ফুটোয়, নির্বাক দর্শকের মত এক চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। দরজার ওপাশে আমি বুঝতে পারছি না আমার এতো ভালো বাবা কেন লাল লাল চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বাবা রুমে ঢোকার পর থেকেই আমি অনবরত বকবক করে যাচ্ছি। আমার সায়েন্স ফেয়ারের প্রজেক্টে প্রথম হওয়ার গল্প বলছিলাম। এই গল্প বলার জন্যই জেগে ছিলাম এতো রাত পর্যন্ত। আমার গল্প শোনার জন্যই তো বাবা ঘরে ঢুকেছে। কিন্তু আজ যেন রাজ্যের নীরবতায় ধরেছে বাবাকে, হৈ-হল্লা করা মানুষটা আজ টু শব্দও করছে না। কেমন যেন চোখে গ্রেহাউন্ডের মত দৃষ্টি। নাহ এইতো বাবা এগিয়ে আসছে আমার দিকে, নিশ্চয়ই আমাকে জড়িয়ে ধরতে? কি যে ছাইপাঁশ ভাবি আমি! বাবা ঠিকই জড়িয়ে ধরেছে, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না বাবার নিঃশ্বাস এতো ভারী কেন? আমার দাঁত বের করা হাসি ম্লান হওয়ার আগেই কি জানি ঘটে গেলো। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার গায়ের জামা একটানে ছিড়ে ফেললো বাবা। বাবার হাত পৌঁছে গেলো আমার দু'পায়ের মাঝে। এরপরেই আমার আর কিছু মনে থাকার কথা না। কিন্তু আমার মনে আছে। বাবার শরীর থেকে ওয়াইন আর সিগারেটের এক মিশ্র তীব্র গন্ধ আমাকে গ্রাস করে, আর আমার শীর্ণ হাত দুটো বাবার কঠিন থাবার সাথে যুদ্ধ করায় কখন ইস্তফা দিয়েছে সেই খেয়াল আমার নেই। খেয়াল হলো যখন দু'পায়ের মাঝে ভীষণ ধাক্কা খেলাম, ইলেকট্রিক শক খাওয়া কয়েদির মত পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। আর ঐ চামড়ার মাঝে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাকা খাওয়ার যেই অনুভূতি এতদিন ধরে বয়ে বেড়াচ্ছি? তার সূচনা সেই রাতেই।

চাবির ফুটোতে চোখ রাখা আমার মনোযোগী নিউরন আর সইতে পারে না। তার আলাদিনের গালিচায় করে উড়াল দেয় সুখী দিনগুলোতে। যখন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। অথবা সেদিন যখন বাবার হাত ধরে সিঙ্গাপুরে ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে এত্ত বড় মিনিয়ন দেখেছিলাম। এতবার জড়িয়ে ধরা বাবাটার গায়ের গন্ধ আমি মনে করতে পারি না, ঐ হাতগুলো যে কখনো আমার আশ্রয় ছিল তা আমার বিশ্বাস হয় না। বেচারা নিউরন খুব বেশিক্ষন সুখী মুহূর্তে থাকতে পারে না। আমার সেই জ্বলার অনুভূতিটা আবার ফেরত আসে। এই এক তেঁতো অনুভূতি নিয়ে গত ৫ বছর চলছি।

শরীরের ক্ষতগুলো কেমন ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়, নতুন চামড়া গজায়। আমার এই জ্বলে খাঁক হয়ে যাওয়া ক্ষত কবে শুকাবে? এসাইনমেন্ট কিংবা পরীক্ষার পড়া করার ফাঁকে আমার নাকে এসে লাগে তীব্র ওয়াইনের গন্ধ। নিজেকে বেশ প্রতিভাবান কুকুর মনে হয়, না চাইতেও গন্ধ পেয়ে যাই। যখন সবাই বিরিয়ানির গন্ধ পায় তখন আমার নাকে বেনসন সিগারেটের আদিম গন্ধ বাসা বাঁধে। আমি খুব চেষ্টা করি আমার অতি প্রিয় বেলি ফুলের গন্ধ নিতে, কিংবা ঘরোয়ার বিখ্যাত তেহারির পেট মোচড়ানো গন্ধটা অথবা প্রথম বৃষ্টির সোঁদা গন্ধটুকু গায়ে মাখতে। কিচ্ছু পারি না! আমার নাসারন্ধ্রের মধ্যে দিয়ে বুক চিরে শুধু ওয়াইন আর সিগারেটের গন্ধ ঢোকে। এত্ত আধুনিক আজকের সায়েন্স, তবু আমার দু'পায়ের মাঝে এতো প্রাচীন জখমটা সারে না কেন? শুনেছি প্রতি সাত বছর পর মানুষের শরীরের সব কোষ নতুন করে জন্মায়। আমি ভীষণ আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি সাত বছর পূরণ হওয়ার জন্য, একটা আনকোরা নতুন শরীরের জন্য। এই জ্বলার অনুভুতিটা যদি তাতে সারে? যদি আমি আবার বেলি ফুল, ঘরোয়ার তেহারি কিংবা শ্রাবণের প্রথম বৃষ্টির গন্ধটা পাই? যদি আমি...... যদি আমি আরেকটা বার বাবার গায়ের সুবাসটা মনে করতে পারি?
                                                     ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সাদিয়া নূর মিথিলা

Comments

  1. আপনার উচিত লেখাগুলো সামাজিক প্লাটফর্মে শেয়ার করা।এটলিস্ট সস্তা বস্তা পচা লেখার ভীড়ে এমন দু একটা লেখা অক্সিজেনের মত লাগবে পাঠকদের কাছে।

    অনুরোধটি বিবেচনা করবেন

    ReplyDelete
  2. নেশা ধরে গিয়েছিল পড়ার সময়। ঘোরে চা কে পানি করে খেয়েছি মনে করতে পারছিনা।

    ReplyDelete
  3. এত ভালো লিখো তুমি, ধন্যবাদ শুভ্র কে, তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য, কারণের উৎস যাই হোক না কেন !

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

হসন্ত-২

অচেনা সিম্ফোনি

তোমরা বরং “বংশোদ্ভূত”ই থাকো!