অনুযোগের অভ্যাস

ঝুম বৃষ্টির চেয়ে ঝিরঝিরে বৃষ্টি আমার বেশি পছন্দের। শরীর ভেজে না, মন ভিজে যায়। ক্যান্সার হাসপাতালের মাঝের ছোট্ট ব্রিজের উপর দাড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম। ছোট্ট একটা কাজে এসেছিলাম। সময়ের আগেই চলে আসায় কানে অনুপমের "আমি আজকাল ভালো আছি" নিয়ে ঠায় দাড়িয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। এই আবহাওয়ায় এমন উপায় যে ভীষণ উপাদেয় তা অস্বীকার করারও জো নেই।

মানুষ দেখা পৃথিবীর মধুরতম নেশা। বিশেষ করে বর্ষার কদম ফুল কিংবা কয়েক জোড়া ব্যাঙের ডাক বঞ্চিত  বৃষ্টিবন্দী মানুষের জন্য। আমি মানুষ দেখছিলাম। একজন, এক জোড়া কিংবা পুরো পরিবার। মানুষেরাও আমাকে দেখছিলো। কেবিনে যেসব পরিবার কেমোথেরাপি কিংবা সার্জারির জন্য ভর্তি আছে তাদের আত্মীয়-স্বজনেরা। দাঁত মাজতে মাজতে বৃষ্টির সাথে একজন মেয়েকে দেখাও কম সুখকর নয়। কতজনকে কবি বানিয়ে দিলাম আজ কে জানে! 

আমার জীবনের মূল উদ্দেশ্য প্রস্থান। উঁহু, পালিয়ে যাওয়া নয় কিংবা ক্লান্ত হয়ে গেছি বলে চলে যাওয়া নয়। বরং হাঁপিয়ে যাওয়ার আগেই, মুখোশের মত চামড়ায় সংসার আটকে যাওয়ার আগেই প্রস্থান। যতটুকু জীবন আমি যাপন করতে চাই তার সবটুকু করেই তবে যাবো, হারিয়ে যাবো। পাহাড়ে কিংবা সাগরে। আমার মৃত্যু যেন আপন মানুষদের মাঝে না হয়। আপন মানুষদের চোখে চোখ রেখে মৃত্যু আমার বড় অসহায় লাগে। এই কথাগুলোই বলছিলাম কাল রাতে আমার বন্ধুকে। এইসব উদ্ভট ইচ্ছায় আমার রসদ কিংবা সমর্থন কোনটারই অভাব হয় না কখনো। 

বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচতে স্বামী-স্ত্রী এক গামছার নিচে করে দৌড়ে আসছিলেন হাসপাতালের গেটে। বগলের নিচে খুব যত্নে একটা ফাইল ধরে রাখা। গেইটের কাছে এসে স্বামীর মুখ মুছে দিচ্ছিলেন স্ত্রী তার ওড়না দিয়ে। কার ক্যান্সার হয়েছে কে জানে। হয়তো একসাথে থাকার সময় তাদের ফুরিয়ে আসছে কিংবা সময়টা দীর্ঘায়িত করার সংগ্রাম চালাচ্ছেন সর্বস্ব দিয়ে। এসব আমার মত মানুষ শুধু ব্রিজে দাঁড়িয়ে দেখতে পারবো, দীর্ঘশ্বাসও ফেলতে পারবো হয়তো কিন্তু ছুঁতে পারবো না। আমি হলাম জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছোঁয়া সমাজ। সমাজের এই স্তরে যতই বৃষ্টি হোক, পানিও লাগে না, কাদাও ভরে না। গান বদলাতে যাবো, ফোনের স্ক্রিনে দেখি মেসেজ এসেছে, "জানো আজকে সকালে না আমার কানে পিপড়া ঢুকেছে। তেল দিলাম তাও কাজ হলো না। চুলের ক্লিপ দিয়ে খোঁচা দিয়েছি। পিপড়া বের হয়ে গেছে। দুইটা লাল পিপড়া। কি কান্ড বলো তো?" 

প্রস্থানের ব্যাপারটা আরেকবার ভেবে দেখতে হবে। সংসার ছাড়া যায়, অভিযোগ থেকে পালানো যায়, কিন্তু অনুযোগের অভ্যাসগুলো? 

Comments

Popular posts from this blog

হসন্ত-২

অচেনা সিম্ফোনি

তোমরা বরং “বংশোদ্ভূত”ই থাকো!