ভয়
আমার পড়াশোনাটা
বোধহয় বিদ্যাসাগর সাহেব মায়ের সাথে দেখা করার জন্য সাঁতরে পার হবার সময় কাঁধে করে
নিয়ে গ্যাছেন। আর ফেরত আসার নাম নেই। কালকে ভাইরোলজি কুইজ। মাথায় এখন
রাইনোভাইরাসের জিনোম কিভাবে মাল্টিপ্লাই করে সেই বিদ্যে ঘোরার কথা। কিসের কি! ওসব
আর আজকে রাতে আমার মাথায় ঢুকবে না। তারচেয়ে বরং সেদিনের গল্প লিখি। কোনদিনের গল্প?
কতদিনের গল্পই তো আছে। আচ্ছা যে কোন একদিনের গল্প লিখে ফেলি।
মানুষ
হিসেবে আমি লেট লতিফ গোত্রের নই মোটেও তবে কিভাবে কিভাবে যেন আজকে সময়ের হিসাবটা
গ্যাঞ্জাম লেগে গ্যাছে। প্রেমিক মহোদয় আমার নেহায়েত ভদ্র মানুষ নাহলে এতক্ষনে ফোন
দিয়ে জ্বালিয়ে ফেলতেন। তাড়াহুড়া করে ঢুকলাম মার্কেটে। ক্যাপসুল লিফটে উঠে মানুষের
মাঝে চ্যাপ্টা হবো নাকি চলন্ত সিঁড়িতে উঠবো ভাবতে ভাবতে দেখি নিজের অজান্তেই
সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিয়েছি। নাহ! মাথার সাথে সাথে হাত-পাও ইদানীং বেয়াড়া হয়ে
গ্যাছে! সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই মহাশয় নিজের যন্ত্র চালানো নিজের ডিরেকশনে চালানো
শুরু করে দিয়েছেন।
“বাবা
এক পা দাও আগে, দেখবা উঠে গেস” এক বাচ্চার বাবা নিজের হাত দিয়ে জোর করে চেষ্টা
করলেন। পারলেন না ছেলেকে এস্কেলেটরে ওঠাতে। “বাবা এই সিঁড়িটা পচা! শুধু উপরে চলে
যায়। আমি পারবো না এটায় উঠতে” সরল বাচ্চার কঠিন প্রত্যাখান। “না বাবা পারবা- বলতে
বলতেই ভদ্রলোকের চোখ পড়লো আমার দিকে। আমি তাড়ায় আছি বুঝতে পেরেই হয়তো অথবা বাচ্চার
জেদের কাছে খানিকটা হার মেনেই আমার পথ ছেড়ে দিলেন। আমি শ্রীমতী কর্মকাণ্ডহীন দর্শক
বাচ্চার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বহুদিনের অভিজ্ঞ আধুনিকতার পা চালালাম পচা
সিঁড়ির দিকে। উপরে উঠে আরেক সিঁড়িতে ওঠার আগেই চোখ আটকে গেল আবার আগের সিঁড়ির
গোঁড়ায়। বাঙালি গৃহবধূ দেখেছেন? না ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত অথবা বিত্তবান হাইব্রিড
প্রজাতির হিন্দি সিরিয়াল দেখা গৃহবধূর কথা বলছি না। এক কলসি কোমরে আরেক কলসি মাথায়
নিয়ে একটু বাঁকা হয়ে হাঁটা অথবা লাকড়ির চুলায় ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে রাখতে গিয়ে
চোখ লাল করে ফেলা গৃহবধূর কথা বলছি। সিঁড়ির গোঁড়ায় চোখেমুখে রাজ্যের ভয় নিয়ে
দাড়িয়ে থাকা গৃহবধূটি সেই প্রজাতির। ঢাকাতেই থাকেন হয়তো, তবে বেশিদিন হয়নি কোমর
থেকে কলসি নেমেছে। “আরে তুমি অহনই র্যালিং এ আত দিও না। আগে পাউ বাড়াউ। হ্যার পরে
র্যালিং দইরো” মহিলার স্বামী তাগাদা দিতে থাকেন পেছন থেকে। “তুমি কি কও? এইডা
ক্যামুন ডর পাওয়া সিঁড়ি। আমি উঠতে পারতাম না!” মুখ ঝামটা মেরে ওঠেন স্বামীর দিকে
তাকিয়ে। এই রে! আমি কি এখন হল বাদ দিয়ে সিঁড়ির পাশে সিনেমা দেখা শুরু করলাম নাকি?
ব্যাগের মধ্যে আধুনিকতার আরেক জারজ সন্তান কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমার প্রেমিক মহোদয়
বোধহয় সিনেমার টিকেট হাতে এতক্ষণে সিনেপ্লেক্সের উঠোনে ১০বার চক্কর দিয়ে ফেলেছেন।
যাই বাবা! চলেই যাচ্ছিলাম কিন্তু ওই ছোট বাচ্চাটা দেখি বাবার হাত ধরে গুটি গুটি
পায়ে আবার এগিয়ে আসছে এস্কেলেটরের দিকে। গোল্লায় যাক ডেডপুল। ওই মুভি টরেন্টেও
পাওয়া যাবে। আর নারীজাতির কি প্রেমিকের কাছে বাহানার অভাব? কিছু একটা বানিয়ে বলে
দেবো নে। ওই পিচ্চিটা বাবার হাতে আলতো করে ভর দিয়ে উঠে পড়লো পচা সিঁড়িতে। ওর হাসি
দেখে মনে হচ্ছিলো বাংলাদেশ থেকে মুসা ইব্রাহীমের আগে ও এভারেস্টে উঠেছে। আর সেই
গৃহবধূও পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিয়ে ডর-পাওয়া সিঁড়িতে উঠেই পড়লেন। আধুনিক সিঁড়িতে
ওঠার অভিজ্ঞতা না থাকলে কি হবে কলসি কাঁখে বাঙালি গাঁয়ের বধুর ব্যালেন্স
অলিম্পিকের খেলোয়াড়ের চেয়ে কন অংশে কম? ভদ্রমহিলার হাসিটাও মাশাল্লাহ দেখার মত।
আচ্ছা হাসিটা এত পরিচিত লাগছে কেন? ও হ্যাঁ! বাচ্চাটার হাসিও অবিকল একই রকম। আর হবেই
না বা কেন? এই পচা আর ডর-পাওয়া সিঁড়ির সামনে দুজনের বয়সতো একই। সব শিশুদের হাসিতে
প্রকৃতি এক অদ্ভুতরকমের মিল দিয়েছে তাই না?
Comments
Post a Comment